আমাদের জীবনধারণের জন্য যে আবশ্যকীয় উপাদান আছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাতাস। বাতাস বা অক্সিজেন ছাড়া আমরা কতক্ষণ বাঁচতে পারি? খুব বেশি হলে দুই কিংবা তিন মিনিট। এই বাতাস যদি দূষিত হয়, অর্থাৎ এতে যদি নানা রকম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ (যেমন: CO, SO2, SO3, NO 2 ইত্যাদি), ধূলাবালির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা থাকে, তবে সেটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে অক্সিজেনের সাথে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং প্রাণঘাতী ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো নানা রকম রোগ সৃষ্টি করতে পারে। একইভাবে এই রাসায়নিক পদার্থ গাছপালা, মাটি এবং অন্যান্য প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। বাতাসের মতো পানিও আমাদের জীবনধারণের জন্য খুবই জরুরি একটি উপাদান। नम- নদীর পানি দূষিত হলে সেখানে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। বাতাস এবং পানির মতো পরিবেশের প্রতিটি উপাদানই আমাদের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। তাই এই পরিবেশ যদি মানসম্মত এবং উন্নত না হয় তাহলে এক সময় সেটি জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় রকমের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে এবং এক সময় আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়বে। তাই এ ব্যাপারে আমাদের নিজেদের যেমন সচেতন হতে হবে, ঠিক সেরকম আশপাশে সবাইকে সচেতন করতে হবে।
প্রকৃতি সংরক্ষণশীলতা হলো আমাদের প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা। আমাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ হচ্ছে বাতাস, পানি, মাটি, গাছপালা, প্রাণিজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, তেল, গ্যাস ইত্যাদি। আমাদের জীবনধারণের জন্য প্রতিটি সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ। বাতাস, পানি না থাকলে বা ধ্বংস হলে আমরা যেমন বাঁচতে পারব না, তেমনি তেল, গ্যাস আর গাছপালা ছাড়াও বেঁচে থাকা অসম্ভব। আমরা যদি আমাদের প্রকৃতি সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা না নিই, গাছপালা বনজ সম্পদ নিধন বন্ধ না করি, বাতাস, পানি ইত্যাদি দূষণ বন্ধ না করি, তাহলে আমাদের এই প্রকৃতি একসময় আর বাসযোগ্য থাকবে না এবং আমরা আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারব না।
প্রকৃতি সংরক্ষণশীলতার বেশ কয়েকটি কৌশল আছে। সেগুলো হলো:
১. সম্পদের ব্যবহার কমানো
আমরা পরিমিত সম্পদ ব্যবহার করে সম্পদ রক্ষা করতে পারি। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বাজার থেকে কিছু কিনে আনলে একটি নতুন প্যাকেট দেওয়া হয়। আমরা যদি একটি প্যাকেটই বারবার ব্যবহার করি, তাহলে সম্পদের ব্যবহার সীমিত করা সম্ভব। আজকাল প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমরা টিস্যু, ন্যাপকিন ব্যবহার করি। একটুখানি সতর্ক হলেই এগুলোর ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া সম্ভব। এবার তোমরা নিজেরা বের কর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোন কোন কাজে এভাবে সম্পদের ব্যবহার কমিয়ে প্রকৃতি সংরক্ষণ করতে পারি। একসময় অফিস-আদালতের সকল কাজকর্মে কাগজ ব্যবহার করতে হতো। এখন বেশির ভাগ কাজ কম্পিউটার ব্যবহার করে করা হয় বলে কাগজের ব্যবহার কমে গেছে। অনেক অফিস কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাগজের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করে “কাগজবিহীন অফিস” প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কাগজ তৈরি হয় গাছপালা থেকে, কাগজের ব্যবহার কমানোর অর্থই হলো গাছপালা কম কাটতে হবে আর তাতে বনজ সম্পদ রক্ষা পাবে অর্থাৎ প্রকৃতির সংরক্ষণ হবে।
২. দূষণ থেকে সম্পদ রক্ষা
করা আমাদের প্রকৃতি বা সম্পদ দূষিত হলে সেটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো নদ-নদীর পানি। তোমরা অনেকে হয়তো বুড়িগঙ্গা নদীর কথা জান। দূষণের ফলে নদীর পানি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে আজ আর বুড়িগঙ্গা নদীতে মাছ তো দূরের কথা, কোনো জলজ প্রাণীই খুঁজে পাওয়া কঠিন। বুড়িগঙ্গা নদীর মতো বাংলাদেশের অনেক নদীই দূষণের শিকার হয়েছে। এসব দূষণ রোধ করা না গেলে এমন এক সময় আসবে যখন নদ-নদীতে মাছই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনিয়ন্ত্রিত কল-কারখানা, যানবাহনের ধোঁয়া ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশের অনেক শহরে বিপজ্জনকভাবে বায়ুদূষণ হয়েছে। বায়ুদূষণে পৃথিবীর প্রথম ১০০টি শহরের মাঝে বাংলাদেশের আটটি শহরের নাম রয়েছে।
৩. একই জিনিস বারবার ব্যবহার করা
সম্ভব হলে একই জিনিস বারবার ব্যবহার করে প্রকৃতি সংরক্ষণ করা যায়। আজকাল কম্পিউটারের প্রিন্টারে বা ফটোকপি মেশিনে অসংখ্য কাগজ ব্যবহার করা হয় এবং অনেক সময়েই সেখানে শুধু একটি পৃষ্ঠা ব্যবহার করা হয়। একটুখানি সচেতন হলেই কাগজের অন্য পৃষ্ঠা আমাদের নানা কাজে ব্যবহার করতে পারি। ব্যানার বিলবোর্ডে যে পলিথিন ব্যবহার করা হয়, সেগুলো অনেক উন্নত মানের, সেগুলো সংগ্রহ করে ব্যাগ তৈরি বা অন্য কাজে ব্যবহার করা যায়। প্রতিদিন আমরা অনেক প্লাস্টিকের বোতল ছুড়ে ফেলে দিই। খুব সহজেই সেগুলো পুনর্ব্যাবহার বা Recycle করা সম্ভব। আমাদের ব্যবহার্য অনেক জিনিস শিল্প-কারখানায় তৈরি হলেও তা কোনো না কোনো পর্যায়ে প্রকৃতির উপরই নির্ভরশীল। কাজেই একই জিনিস বারবার ব্যবহারে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চাপ কমে এবং এতে প্রকৃতি সংরক্ষণ হয়।
৪. ব্যবহৃত জিনিস ফেলে না দিয়ে তা থেকে নতুন জিনিস তৈরি করা
পুরাতন জিনিস একেবারে ফেলে না দিয়ে তা থেকে নতুন জিনিস তৈরি করেও প্রকৃতি সংরক্ষণ করা যায়। আমাদের কালচারে সেটি আমরা বহু আগে থেকে করে আসছি, কাঁথা হচ্ছে তার উদাহরণ। পুরাতন কাপড় বা শাড়ি ফেলে না দিয়ে সেগুলো দিয়ে কাঁথা তৈরি করা হতো। ঠিক সেরকম পুরাতন কাগজ দিয়ে ঠোঙ্গা, পুরোনো টায়ার থেকে স্যান্ডেল কিংবা গৃহস্থালির বর্জ্য থেকে জৈব সার এ ধরনের নানা রকম জিনিসের কথা বলা যায়।
৫. প্রাকৃতিক সম্পদ পুরোপুরি রক্ষা করা
প্রকৃতি সংরক্ষণশীলতার একটি অনন্য উপায় হলো এর বিরোধিতা না করে একে রক্ষা করা বা এতে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না করা। তোমরা হয়তো জান, অনেক দুষ্কৃতকারীরা সুন্দরবনে হরিণ, বাঘ এগুলো শিকার করে বা চুরি করে গাছ কাটে। শীতের পাখিকে ধরে বাজারে বিক্রয় করে, সমুদ্র উপকূলে অনিয়ন্ত্রিত অপরিকল্পিত জাহাজ ভাঙা শিল্প পড়ে তুলে সমুদ্রের পানিকে দূষিত করা। এসব কার্যক্রম বন্ধ করাই হলো প্রকৃতি সংরক্ষণ। সুন্দরবনের খুব কাছে কলকারখানা বসিয়ে বায়ুদূষণ করে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে। সুন্দরবনের মতো আমাদের অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ অনেকাংশে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, যা রোধ করা অতি আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
দলগত কাজ: তোমাদের স্কুলের আশপাশে কোথায় কোথায় পরিবেশদূষণ হচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন লিখো। স্কুলের মাধ্যমে সেটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাঝে পাঠিয়ে দেখো পরিবেশদূষণ বন্ধ করা যায় কি না।
দলগত কাজ: তোমার এলাকায় মানসম্মত ও উন্নত পরিবেশ সৃষ্টির অন্তরায় কী এবং সে জন্য করণীয় কী হতে পারে, সেগুলো চিহ্নিত কর। ৪-৫ জন বন্ধু বা সহপাঠী মিলে একটি গ্রুপ তৈরি কর। নিজ নিজ এলাকায় পরিবেশগত সমস্যা চিহ্নিত কর। এক্ষেত্রে পানিদূষণ, যত্রতত্র ময়লা ফেলা, খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ ইত্যাদি বিবেচনায় রাখ। এসব দূষণের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে পোস্টার বা লিফলেট তৈরি করে সবার মাঝে বিলি কর। পত্রপত্রিকায় চিঠি লিখো, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহযোগিতা কাজে লাগাও। প্রয়োজনবোধে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, পরিবেশবাদী সংগঠন, বেসরকারি সংস্থার সাহায্য নাও ।
আরও দেখুন...